খুলনা, বাংলাদেশ | ৩১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১৪ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  ইসরায়েলকে লক্ষ্য করে শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ ইরানের

ঘটনাবহুল তার জীবন, একাকীত্বই এখন সঙ্গী

একরামুল হোসেন লিপু

প্রতিদিন ভোরে স্ট্রেচারে ভর করে বাওয়ালী ঘাট জামে মসজিদে ফজরের নামাজ শেষে মসজিদের পার্শ্ববর্তী শতবর্ষী তেঁতুলতলার নীচে নিঃসঙ্গ বসে থাকেন ৭৫ বছর বয়সী খান আবদুল হাফিজ। নিঃসঙ্গ একাকীত্ব জীবন তার। স্ত্রী সন্তান কেউ নেই। নিজের পৈত্রিক ভিটায় ছোট একটি কক্ষে বসবাস করেন। সকালে নাস্তা করেন নিজ খরচে। দুপুর আর রাতের খাবার দুই ভাইয়ের বাসা থেকে আসে।

ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিগন্যাল কোরের সদস্য। যুদ্ধের সময় অন্যান্য বাঙালি আর্মিদের সঙ্গে তিনিও আটক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের মহেঞ্জোদার আর্মি ক্যাম্পে। ১৯৭৫ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আটককৃত বাঙালি আর্মিদের দেশে ফেরত পাঠায়। দুই মাস ছুটি কাটানোর পর যোগদান করেন রংপুর ক্যান্টনমেন্টে। চোখের সামনে জুনিয়রদের পদোন্নতির অনিয়ম সহ্য করতে না পেরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে চলে আসেন। এই অপরাধে আর্মি সিভিল কোর্টে তার তিন মাসের সাজা হয়।

রংপুর ক্যান্টনমেন্টে সাজা ভোগ করে সোজা চলে আসেন নিজ বাড়িতে। বাড়ি আসার দুই বছর পর তার জীবনে ঘটে এক মর্মান্তিক ঘটনা। প্রতিদিনের ন্যায় ঘটনার দিনও তিনি দুপুরে গোসল করতে ভৈরব নদীর তীরে যান। প্রতিবেশী অসহায় এক যুবকের কাছে অন্য এক যুবক পিকনিকের পাওনা দুই টাকা আদায়ে শাসাতে থাকে তাকে । ঘটনার প্রতিবাদ করেন খান আব্দুল হাফিজ। এক পর্যায়ে পাওনাদার যুবক ঝন্টুকে তিনি কাঠ দিয়ে আঘাত করেন। পাওনাদার যুবক ঝন্টু এ সময় আত্মরক্ষার্থে কাত হয়ে গেলে আঘাতটি তার মাথায় লাগে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মাথায় প্রচন্ড আঘাতের কারণে ঘটনার দুই দিন পর তার মৃত্যু হয় ।

ঝন্টুর পরিবার হত্যা মামলা দায়ের করেন খান হাফিজের বিরুদ্ধে। গ্রেপ্তার হন খান আব্দুল হাফিজ। আইনি প্রক্রিয়া শেষে তার সাজা হয় মৃত্যুদণ্ড। হাফিজের পরিবার নিম্ন আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত হাইকোর্টে আপিল করেন। আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। পরবর্তীতে আবারও তার পরিবার হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে যাবজ্জীবন সাজা কমিয়ে ১০ বছর সাজা বহাল রাখা হয়। একটানা সাত বছর সাজা ভোগ করে জেল থেকে বের হয়ে বাড়িতে আসার দুই বছর পর তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।

কিন্তু সে বিবাহ বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হয় না। এরপর থেকে শুরু হয় খান আব্দুল হাফিজের নিঃসঙ্গ একাকীত্ব জীবন। এলাকার ছোট বড় সবার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা আর রসিকতা করে অন্তরের ভিতর জমে থাকা কষ্টগুলো দূর করার চেষ্টা করেন।

খান আব্দুল হাফিজের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের এক মুসলিম পরিবারে। তার পিতা মরহুম মাওলানা ফজল উদ্দিন খান। বড় ভাই খান আব্দুর রশিদ বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন। মেজ ভাই ডাক্তার আব্দুল হালিম, সেজ ভাই মাওলানা আব্দুল গফুর। ছোট ভাই মারা গেছেন।

খান আব্দুল হাফিজ খুলনা গেজেটকে বলেন, সম্ভ্রান্ত পরিবারের জন্মেছি। ভাইয়েরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত। নিজেও দৌলতপুর মুুহসিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা শেষে ১৯৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিগনালম্যান হিসেবে চাকুরিতে যোগদান করি। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়নি। দেশ স্বাধীনের পর পদোন্নতির অনিয়ম দেখে সহ্য করতে না পড়ে চাকরি ছেড়ে চলে আসি। এরপর মার্ডার কেসের আসামি হয়ে ৭ বছর জেল খেটেছি। জেল থেকে বের হয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি। কিন্তু সেখানেও ভাগ্য সহায় হয়নি। সে বন্ধন টেকেনি। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, এলাকার ছোট বড় সবার সঙ্গে হাসি-ঠাট্টা আর রসিকতা করে মনের অস্থিরতার, অশান্তি, আর কষ্টগুলো দূর করার চেষ্টা করি ।

বাওয়ালি ঘাট জামে মসজিদের খেদমতের কাজ করতাম। চার বছর আগে মসজিদের ছাদ থেকে পড়ে বাম পা ভেঙ্গে যায়। কিন্তু সে পা এখনো স্বাভাবিক হয়নি। স্ট্রেচারে ভর করে চলাফেরা করতে হয়। জীবনের শেষ পর্যায়ে এভাবে নিঃসঙ্গ একাকীত্ব জীবন যাপন করতে হবে কখনও ভাবি নাই্।

খুলনা গেজেট/এইচ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!